হাইব্রিড ঢেঁড়স চাষের আধুনিক পদ্ধতি !
কৃষিবিদ এম এ মনসুর লিয়নঃ ঢেঁড়স বাংলাদেশের বহুল জনপ্রিয় একটি সবজি। এই সবজিটি পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি সবজি যা খ্রীষ্টের জন্মেরও হাজার বছর আগে ইথিওপিয়ায় উৎপত্তি হয়েছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন জলদস্যুর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
ঢেঁড়সে প্রচুর পরিমানে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান যেমনঃ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম,ম্যগনেসিয়াম, ফসফরাস, আয়োডিন, ভিটামিন এ, বি এবং সি যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
ঢেঁড়সের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিঃ
![]() |
সারিবদ্ধ গাছের জমি |
জমি নির্বাচনঃ
দো-আঁশ এবং বেলে দশ-আঁশ মাটি ঢেড়স চাষের জন্য উপযোগী। ঢেঁড়স গাছ পানি সহ্য করতে পারে না তাই সেচ এবং নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত উচু জমি ঢেঁড়স চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জাত নির্বাচনঃ
ঢেঁড়স চাষের জন্য জাত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ন। একটা সময় ছিল যখন আমরা শুধুমাত্র দেশি জাতের উপর নির্ভশীল ছিলাম। দেশি জাত শুধুমাত্র খরিফ মৌসুমে চাষাবাদ করা যেত এবং প্রচুর ভাইরাসে আক্রান্ত হতো। এখনো অনেক চাষি না বুঝে সেইসব পুরোনো জাতগুলো চাষাবাদ করছে এবং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দেশি জাতগুলোর যেখানে ঢেঁড়স ধরে সেই ইন্টারনুড দূরত্ব খুব বেশি তাই গাছ অনেক লম্বা হলেও ঢেঁড়সের সংখ্যা কম হয় ফলে ফলনও খুব কম হয়। তাছাড়া অমৌসুমে চাষ করলে ব্যপকভাবে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গাছ মারা যায়।
তাই আপনাকে এমন জাত নির্বাচন করতে হবে যা সারাবছর চাষ করা যায়, ভাইরাসমুক্ত এবং ইন্টারনুড দূরত্ব কম। বর্তমানে এইসব বৈশিষ্টসম্পন্ন হাইব্রিড জাত বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এই হাইব্রীড জাতগুলো চাষ করলে আপনি সারাবছর ঢেঁড়স চাষ করে অধিক লাভবান হতে পারবেন।
হাইব্রীড ঢেঁড়সের জাতসমুহঃ মুকুট, বুলেট, সুবর্ন সুপার, প্রদীপ, সুমি, গুগলী, নোলক ইত্যাদি।
বীজ সংগ্রহঃ
উল্লেখিত জাতগুলোর বীজ প্রায় সকল জায়গায় পাওয়া যায়। বানিজ্যিকভাবে চাষ করলে বীজের গুনগত মান নিশ্চিত করতে অবশ্যই জনপ্রিয় এবং বড় কোম্পানীর বীজ ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্র্যাক সবসময় বীজের গুনগত মান নিশ্চিত করে থাকে। ব্র্যাকের হাইব্রীড মুকুট ঢেড়সের জাতটি অধিক ভাইরাস সহনশীল এবং ফলনশীল।
জমি তৈরিঃ
প্রতি শতাংশ জমিতে ৮০ কেজি গোবর অথবা জৈব সার এবং ৫০০ গ্রাম জিপসাম ছিটিয়ে আড়াআড়িভাবে কয়েকটি চাষ দিতে হবে। শেষ চাষের সময় ৮০০ গ্রাম টিএসপি, ৩০০ গ্রাম এমওপি, ৫০ গ্রাম জিঙ্ক এবং ৫০ গ্রাম বোরন সার ছিটিয়ে মই দিয়ে জমি সমান করে নিতে হবে।
বীজের পরিমানঃ প্রতি শতাংশে ৪০-৪৫ গ্রাম এবং একর প্রতি ৪.০-৪.৫ কেজি বীজের প্রয়োজন।
বপন সময়ঃ উল্লেখিত হাইব্রিড ঢেঁড়সের জাতগুলো সারাবছর চাষ করা যায়। তবে আপনি যত বেশি আগাম চাষ করবেন তত বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন।
বীজ বপন পদ্ধতিঃ
বাজার থেকে বীজ ক্রয় করে ১-২ ঘন্টা হালকা রোদে শুকিয়ে ঠান্ডা করে নিতে হবে। পরবর্তীতে ৮-১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৮ ইঞ্চি এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ১২ ইঞ্চি রেখে রোপন করতে হবে। রোপনের পর দুইপাশে নালা রেখে বীজের উপর মাটি উঠিয়ে দিতে হবে যেন গাছের গোড়ায় পানি না জমে এবং নালা দিয়ে সেচ এবং নিষ্কাশনের কাজ করা যায়। ঘন করে রোপন করলে ঢেড়স আকারে ছোট এবং সংখ্যায় বেশি হবে। ফলে ফলন বেশি হবে এবং লাভও বেশি হবে।
সারের উপরি প্রয়োগঃ গাছের ২০ দিন এবং ৩৫ দিন বয়সে ৪০০ গ্রাম করে ইউরিয়া এবং ৩০০ গ্রাম করে এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে একটু দূরে উপরি প্রয়োগ করতে হবে। ্মনে রাখবেন গাছের গোড়ায় যেন সার না লাগে কারন গোড়ায় সারের সংস্পর্শে গাছে পচন ধরতে পারে।
সেচ ও নিষ্কাশনঃ জমিতে প্রয়োজনমত সেচ দিতে হবে। মাটিতে সবসময় জো অবস্থা বজায় রাখতে হবে। মাটি শুকিয়ে গেলে অবশ্যই সেচ প্রদান করতে হবে। ঢেঁড়স গাছ পানি সহ্য করতে পারে না তাই অতরিক্ত বৃষ্টিতে জরুরী ভিত্তিতে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
পোকামাকড় এবং রোগবালাই দমন
অমৌসুমে ঢেঁড়স চাষ করলে পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমন বেশি হয়ে থেকে তাই খুব সতর্ক থাকতে হবে। সঠিক পরিচর্যায় পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
পোকামাকড়
জাবপোকাঃ জাব পোকা ঢেড়স গাছের প্রধান শত্রু। এরা পাতা এবং শাখা প্রশাখার রস শুষে খেয়ে গাছকে দুর্বল করে ফেলে। এরা ভাইরাস স্থানান্তরে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে।
![]() |
এফিড আক্রান্ত গাছ |
দমন পদ্ধতিঃ ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে সম্পুর্ন গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
জ্যাসিডঃ জ্যাসিড চারা অবস্থা থেকে শুরু করে পরিনত গাছের পাতার রস শুষে খেয়ে গাছকে দূর্বল করে ফেলে। এরা মোজাইক ভাইরাসের বাহক হিসেবেও কাজ করে।
![]() |
জ্যাসিড |
দমন পদ্ধতিঃ ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে সম্পুর্ন গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকাঃ এই পোকা ঢেঁড়সের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। এর লার্ভা ঢেঁড়সের ফল ছিদ্র করে ফসলের ব্যপক ক্ষতি করে থাকে পাশাপাশি গাছের ডগা ছিদ্র করে ভিতরের অংশ খেয়ে ফেলে ফলে গাছ মারা যায়।
![]() |
ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা |
আক্রান্ত ফল
রোগবালাই
মোজাইক ভাইরাসঃ মোজাইক ভাইরাস ঢেঁড়সের প্রধান রোগ যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। এই রোগে পাতা হলদে হয়ে কুকড়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গাছে ফল ধরা বন্ধ হয়ে যায়।
![]() |
মোজাইক ভাইরাস আক্রান্ত গাছ |
![]() |
ভাইরাস আক্রান্ত গাছের পাতা |
দমন পদ্ধতিঃ গাছের ভাইরাস রোগের কোন চিকিৎসা নেই তাই ভাইরাস সহনশীল জাত চাষ করতে হবে। আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্রই জমি থেকে উঠিয়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। এছাড়াও জাব পোকা এবং সাদা মাছি ভাইরাস বহন করে থাকে তাই নিয়মিত জাবপোকা দমন করতে হবে।
পাতার দাগ রোগঃ আল্টারনারিয়া নামক একপ্রকার ছত্রাকের মাধ্যমে এই রোগ হয়ে থাকে। প্রথমে পাতায় ছোট ছোট গোলাকার আকৃতির দাগ পড়ে এবং দাগগুলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে সমস্ত পাতায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা ঝরে যায়।
![]() |
পাতার দাগ রোগ |
![]() |
নেমাটোড আক্রান্ত গাছ |
![]() |
নেমাটোড আক্রান্ত গাছের শিকড় |
কোন মন্তব্য নেই