আগাম শিম চাষের আধুনিক পদ্ধতি
কৃষিবিদ এম এ মনসুর লিয়নঃ শিম একটি শীতকালীন জনপ্রিয় সবজি। শীতকালে রোপন করলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমন কম হয় এবং প্রচুর ফলন পাওয়া যায়। আগাম শিম চাষ করলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমন কিছুটা বেশি হয় এবং ফলনও কিছুটা কম হয় তবে সঠিক পরিচর্যায় এগুলো নিয়ন্ত্রন করা যায়। অন্যদিকে শীতকালে রোপন করা শিমের দাম যেখানে প্রতি কেজি ১০.০০ টাকা সেখানে আগাম রোপন করা শিমের দাম কেজি প্রতি ৮০.০০-১০০.০০ টাকা হয়ে থাকে। তাই বানিজ্যিকভাবে আগাম শিম চাষ করলে বেশি লাভবান হওয়া যায়। এছাড়া শিম একটি গুল্মজাতীয় গাছ তাই এগুলো বাড়ির চালে, রাস্তা বা পুকুরের পাড়, জমির আইলেও মাচায় চাষ করা যায়। তাই যারা তরুন উদ্যোক্তা এবং নতুন চাষি তারা বানিজ্যিকভাবে আগাম জাতের শিম চাষ করতে পারেন।
আগাম শিম চাষাবাদের আধুনিক পদ্ধতি
জমি নির্বাচনঃ
দো-আঁশ এবং বেলে দশ-আঁশ মাটি শিম চাষের জন্য উপযোগী। অন্যদিকে শিম গাছ পানি সহ্য করতে পারে না তাই সেচ এবং নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত উচু জমি শিম চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।
জাত নির্বাচনঃ
আগাম শিম চাষে জাত নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ন। সকল জাতই আগাম চাষের জন্য উপযোগী নয় তাই জাত নির্বাচনের সময় খুব সতর্ক থাকতে হবে। আগাম কয়েকটি শিমের জাত হলো ইপসা-১, ইপসা-২, বারি শিম-৩, বারি শিম-৭ তবে ইপসা-২ জাতটি খুবই জনপ্রিয়। বানিজ্যিকভাবে ইপসা-২ জাতটি চাষ করলে বেশি দামে বিক্রি করা যায় এবং অধিক লাভবান হওয়া যায়।
জাতঃ ইপসা-২বীজ সংগ্রহঃ
শিম দেশি জাতের মুক্ত পরাগায়িত ফসল তাই এই বীজ প্রায় সকল জায়গায় পাওয়া যায়। বানিজ্যিকভাবে চাষ করলে বীজের গুনগত মান নিশ্চিত করতে অবশ্যই জনপ্রিয় এবং বড় কোম্পানীর বীজ ব্যবহার করতে হবে। সেক্ষেত্রে ব্র্যাক সবসময় বীজের গুনগত মান নিশ্চিত করে থাকে।
জমি তৈরিঃ
প্রতি শতাংশ জমিতে ৫০ কেজি গোবর অথবা জৈব সার ছিটিয়ে আড়াআড়িভাবে কয়েকটি চাষ দিয়ে মই দিয়ে জমি সমান করে নিতে হবে। অতঃপর ৭ ফুট প্রশস্ত বেড তৈরি করে বেডের দুইপাশে ৪ ফুট দূরে দূরে মাদা তৈরি করতে হবে। প্রতি মাদায় ১০০ গ্রাম টিএসপি, ৫০ গ্রাম এমওপি এবং সামান্য পরিমান জিপসাম, জিঙ্ক এবং বোরন সার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে ১ সপ্তাহ রেখে দিতে হবে।
বীজ বপনঃ
ইপসা-২ জাতটি ১৫মে থেকে শুরু করে অক্টোবর পর্যন্ত চাষ করা যায়। আপনি যত আগাম চাষ করবেন তত বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন। সেই হিসেবে মে-জুন মাস আগাম শিম চাষের উপযুক্ত সময়। প্রতিটি মাদায় ৩-৪ টি বীজ বপন করতে হবে পরবর্তীতে ১-২টি সুস্থ গাছ রেখে বাকিগুলো তুলে ফেলতে হবে।
বীজের পরিমানঃ প্রতি শতাংশে ৩০-৪০ গ্রাম এবং একর প্রতি ৩-৪ কেজি বীজের প্রয়োজন।
গাছে কাঠি দেওয়া এবং মাচা তৈরিঃ
গাছ লতানো শুরু করলে গাছে কাঠি দিতে হবে এবং দ্রুত মাচা তৈরি করতে হবে। মাচা না দিলে বাশের আগা বা কঞ্চি পুতে গাছ উপরে তুলে দিতে হবে।
সার প্রয়োগঃ
চারা রোপনের ১৫-২০ দিন পর পর দুইবার প্রতি মাদায় ৫০ গ্রাম ইউরিয়া এবং ৫০ গ্রাম পটাশ সার দিতে হবে।
পোকামাকড় এবং রোগবালাই দমন
আগাম শিম চাষ করলে পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমন বেশি হয়ে থেকে তাই খুব সতর্ক থাকতে হবে। সঠিক পরিচর্যায় পোকামাকড় এবং রোগবালাইয়ের আক্রমন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
পোকামাকড়
জাবপোকাঃ জাব পোকা শিম গাছের প্রধান শত্রু। এরা পাতা এবং শাখা প্রশাখার রস শুষে খেয়ে গাছকে দুর্বল করে ফেলে। এরা ভাইরাস স্থানান্তরেও গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে থাকে।
জাব পোকা
দমন পদ্ধতিঃ ইমিডাক্লোপ্রিড গ্রুপের কীটনাশক ১ মিলি ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে সম্পুর্ন গাছ ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হবে।
ফল ছিদ্রকারী পোকাঃ এই পোকা ফল ছিদ্র করে ভিতরের অংশ খেয়ে ফেলে ফলে ফসলের ব্যপক ক্ষতি হয়।
দমন পদ্ধতিঃ যেহেতু পোকা ফলের ভিতরে থাকে তাই এমামেকটিন বেনজয়েট অথবা এমামেকটিন বেনজয়েট + থায়ামেথোক্সাম গ্রুপের কীটনাশক ১ গ্রাম ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
রোগবালাই
মোজাইক ভাইরাসঃ মোজাইক ভাইরাস শিমের ব্যপক ক্ষতি করে থাকে। এই রোগে পাতা হলদে হয়ে কুকড়ে যায় এবং গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গাছে ফল ধরে না।
দমন পদ্ধতিঃ গাছের ভাইরাস রোগের কোন চিকিৎসা নেই। তাই আক্রান্ত গাছ দেখা মাত্রই জমি থেকে উঠিয়ে মাটিতে পুতে ফেলতে হবে। এছাড়াও জাব পোকা ভাইরাস বহন করে থাকে তাই নিয়মিত জাবপোকা দমন করতে হবে।
এনথ্রাকনোজঃ এটি একটি ছত্রাকজনিত রোগ। প্রথমে গাছের পাতা, কান্ড এবং ফলে লালচে বাদামী দাগ পড়ে এবং দাগগূলো আস্তে আস্তে বড় হয়ে পাতা কান্ড এবং ফলে পচন ধরায়।
দমন পদ্ধতিঃ কার্বেন্ডাজিম গ্রুপের ছত্রাকনাশক ১ গ্রাম ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
পাউডারি মিলডিউঃ এটি শিমের একটি ক্ষতিকর ছত্রাকজনিত রোগের নাম। এই রোগে প্রথমে গাছের পাতার উপড়ে সাদা পাউডারের মত দাগ পড়ে। পরবর্তীতে ধিরে ধিরে দাগগুলো বড় হয়ে বাদামী বর্ন ধারন করে এবং পাতাগুলো শুকিয়ে ঝরে যায়।
দমন পদ্ধতিঃ পানিতে দ্রবনীয় সালফার ৫ গ্রাম ১ লিটার হারে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
গাছের পরিচর্যাঃ
গাছের গোড়ায় যেন পানি জমতে না পারে সেইজন্য মাদায় মাটি উঠিয়ে সবসময় উচু করে রাখতে হবে। গোড়া আগাছামুক্ত রাখতে হবে। গাছ মাচায় উঠার আগে নিচের শাখা প্রশাখা ছেটে দিতে হবে। মাচায় গাছ অনেক ঘন হয়ে গেলে পাতা ছেটে দিতে হবে এবং লতাগুলো জোড় লেগে গেলে আলাদা করে দিতে হবে।
ফসল সংগ্রহঃ
গাছের বয়স ৪০-৪৫ দিন হলেই গাছে ফুল আসা শুরু হয় এবং ৫৫-৬০ দিন বয়স থেকেই ফল সংগ্রহ শুরু করা যায়। সপ্তাহে ২ বার ফল সংগ্রহ করা যায়।
ফলনঃ সঠিক পরিচর্যায় প্রতি শতাংশে ৭০-৮০ কেজি এবং একর প্রতি ৭-৮ টন ফলন পাওয়া যায়।
কোন মন্তব্য নেই