ভার্টিক্যাল কৃষি: ভবিষ্যতের টেকসই কৃষি প্রযুক্তি ও বাংলাদেশে এর প্রয়োজনীয়তা
কৃষিবিদ এম এ মনসুর লিয়নঃ বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি জমির সংকটের কারণে খাদ্য উৎপাদনের নতুন নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভার্টিক্যাল কৃষি (Vertical Farming) আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার একটি নতুন সম্ভাবনা হিসেবে উঠে এসেছে। এটি এমন একটি কৃষি পদ্ধতি যেখানে ফসল উৎপাদন করা হয় উল্লম্ব স্তরে, যা জমির ব্যবহার কমিয়ে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে।
ভার্টিক্যাল কৃষি কী?
ভার্টিক্যাল কৃষি হলো এমন একটি কৃষি পদ্ধতি যেখানে উদ্ভিদ বা ফসলগুলো স্তরে স্তরে উঁচু করে চাষ করা হয়। সাধারণত এটি বদ্ধ পরিবেশে করা হয় এবং কৃত্রিম আলো, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ ও হাইড্রোপোনিক বা অ্যারোপোনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এটি বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, ভবনের ভেতরে বা ছাদে চাষের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ভার্টিক্যাল কৃষির উপকারিতা
- কম জায়গায় অধিক উৎপাদন: ভার্টিক্যাল কৃষি ঐতিহ্যবাহী কৃষির তুলনায় ৭০-৯০% পর্যন্ত কম জমি ব্যবহার করে।
- পানি সংরক্ষণ: হাইড্রোপোনিক ও অ্যারোপোনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রায় ৯৫% কম পানি ব্যবহার হয়।
- বছরব্যাপী উৎপাদন: জলবায়ু নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থাকায় সারা বছরই ফসল উৎপাদন সম্ভব।
- কীটনাশকমুক্ত কৃষি: বাইরের পরিবেশের সংস্পর্শ কম থাকায় ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের সমস্যা কমে, ফলে কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যায়।
- শহুরে কৃষির প্রসার: শহরাঞ্চলে, ছাদে বা ভবনের ভেতরে কৃষির প্রসার ঘটিয়ে খাদ্য সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে।
ভার্টিক্যাল কৃষির গুরুত্ব
বর্তমান বিশ্বে কৃষিজমির সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে ভার্টিক্যাল কৃষি একটি অপরিহার্য সমাধান হয়ে উঠেছে। এটি শুধুমাত্র খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক নয়, বরং এটি টেকসই কৃষির একটি উদাহরণ, যেখানে কম সম্পদ ব্যবহার করে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা সম্ভব। আধুনিক নগরায়নের ফলে কৃষি জমি দিন দিন কমছে, তাই ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশে ভার্টিক্যাল কৃষির প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশে কৃষি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক খাত, তবে দেশের কৃষিজমি ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এ ছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত বৃষ্টি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতিতে ভার্টিক্যাল কৃষি বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় সমাধান হতে পারে।
- জমির সঠিক ব্যবহার: বাংলাদেশে কৃষিজমির পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে, উল্লম্ব কৃষির মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
- শহরাঞ্চলে কৃষির প্রসার: ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে ছাদ ও ভবনের অভ্যন্তরে এই কৃষি ব্যবস্থা চালু করলে খাদ্য উৎপাদন বাড়বে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কমানো: নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চাষাবাদ হওয়ায় ভার্টিক্যাল কৃষি বন্যা, খরা বা অতিবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের নেতিবাচক প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে সহায়ক হবে।
- পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ: শহরাঞ্চলে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারে এই প্রযুক্তি।
- কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার: ভার্টিক্যাল কৃষির মাধ্যমে বাংলাদেশে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির প্রসার ঘটবে, যা ভবিষ্যতের কৃষি ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে।
ভার্টিক্যাল কৃষির প্রযুক্তি
হাইড্রোপোনিক প্রযুক্তি: মাটির পরিবর্তে পানির মাধ্যমে গাছের পুষ্টি সরবরাহ করা হয়।
অ্যারোপোনিক প্রযুক্তি: গাছের শিকড়কে বাতাসে রেখে স্প্রে করে পুষ্টি সরবরাহ করা হয়।
LED আলো: সূর্যের বিকল্প হিসেবে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করা হয়।
সেন্সর ও অটোমেশন: পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক সেন্সর ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়।
ভার্টিক্যাল কৃষির চ্যালেঞ্জ
যদিও ভার্টিক্যাল কৃষির অনেক সুবিধা রয়েছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে:
উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগ: ফার্ম স্থাপন করতে প্রচুর মূলধন প্রয়োজন।
বিদ্যুৎ নির্ভরতা: কৃত্রিম আলো ও পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিদ্যুতের উপর নির্ভরতা বেশি।
প্রযুক্তিগত জটিলতা: এটি পরিচালনার জন্য উন্নত প্রযুক্তির জ্ঞান থাকা জরুরি।
উপসংহার
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভার্টিক্যাল কৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং শহরাঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। যদিও এটি এখনো অনেক জায়গায় নতুন, তবে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রযুক্তির সাহায্যে এটি বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে একটি বিপ্লব আনতে পারে। সরকারের সহায়তা ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশেও এই চাষাবাদ জনপ্রিয় করা সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই